০৭:১১ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৩ অক্টোবর ২০২৫

একজন নিবেদিতপ্রাণ সমাজহিতৈষীকে স্মরণ

নিউজ আপডেট
নিউজ আপডেট

শহিদুল ইসলাম ফারুক : কালিতারা, জালিয়াল, সল্যাঘটিয়া, কিশোরগঞ্জ জেলার মরহুম ছিদ্দিক উল্লাহ মিয়া। পাক-কিশোরগঞ্জের সামান্য দক্ষিণে আজিজল হক মিয়ার বাড়ি সংলগ্ন রাজবাড়ি। ছিদ্দিক মিয়া ছিলেন মাইজদী মোহাম্মদী প্রেসের মালিক । কিন্তু পেশার প্রতি তার তেমন নজরদারীরি ছিল না। সারাক্ষণ তার চিন্তাভাবনা ছিল এলাকার উন্নয়ন । সকালে বাড়ি থেকে বের হয়ে কিশোরগঞ্জ এসে প্রথম কাজ মোস্তফা মিয়ার দোকানে আরো দুই পরম শ্রদ্ধেয় মরহুম আনোয়ার আহম্মদ আমীন সাহেব ও মরহুম রজ্জব আলী ভূঁইয়া সাহবের সাথে চা খাওয়া। তারপরেই চলতো উন্নয়নের আলাপ।

পাক কিশোরগঞ্জের প্রাইমারী স্কুল, চান মিয়া হাজীর মসজিদ ও মাদ্রাসা, ঈদগাহ, ওবায়েদ উল্লাহ মেমোরিয়াল হাই স্কুলসহ এই ছোট এলাকার সব প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠা ও উন্নয়নে ছিদ্দিক উল্লাহ মিয়ার ভূমিকা ছিল মুখ্য । তখন কালিতারার পরে পশ্চিমে বিদ্যুৎ ছিল না । তিনি চান মিয়া হাজীর মসজিদে বিদ্যুৎ আনার পারমিশন করিয়েছিলেন। কিন্তু সরকার থেকে কোন খুঁটি ও লেবার মজুরি দেয়নি । তিনি বন্ধু-বান্ধবদের, কিশোর ক্লাবের সদস্যদের ও এলাকার যুবকদের সাথে নিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরে গাছ সংগ্রহ করিয়েছিলেন। নিজেরা কেটে সবাই কাঁধে করে বহন করে গর্ত খুঁড়ে খঁটি গেড়ে প্রথম কালিতারার পরে পাক কিশোরগঞ্জের মসজিদে বিদ্যুৎ আনা হয়েছিল।

মুক্তিযুদ্ধ শুরুর ঠিক পূর্ব ক্ষণে এলাকার গৌরব মরহুম ওবায়েদ উল্লাহ সাহেবের যোগ্য সন্তান বাবু মিয়া সাহেবকে তার পিতার নামে উনার স্মৃতি বিজড়িত অঞ্চলে তার স্মৃতি রক্ষায় একটি স্কুল স্থাপনের জন্য উদ্বুদ্ধ করেছিলেন তিনি । তারপর আরো দুই শ্রদ্ধেয় মরহুম রাজ্জাক পাটোয়ারী স্যার ও মরহুম গোলাম মোস্তফা সাহেবের সার্বিক সহযোগিতায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ওবায়েদ উল্লাহ মেমোরিয়াল জুনিয়র হাই স্কুল । এক পর্যায়ে তিন ক্লাসে ছাত্র সংখ্যা দাঁড়ায় জনা বিশেকে । স্কুলগৃহ ঘুর্ণি ঝড়ে পড়ে যায় । স্কুলের চরম দুঃসময়ে ১৯৭৭ বা ১৯৭৮ সালের জানুয়ারীর এক তারিখে নতুন ছাত্র ভর্তি উপলক্ষে তখনকার প্রধান শিক্ষক হাকিম সাহেবকে দিয়ে এক অভিবাবক সভা ডাকেন স্কুলের মাঠে । মহিলা কলেজের প্রিন্সিপ্যাল মরহুম ছালেহ আহমদ স্যার সে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন । আর ছিলেন কালিতারা গার্লস স্কুলের প্রধান শিক্ষক মাহে আলম সাহেব ।
তার কথা মত সবার উপস্থিতিতে আমি আমার বক্তব্যে প্রধান শিক্ষক হাকিম সাহেবকে বাদ দিয়ে প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ কুমিল্লা বোর্ডের বাংলা ও ইংরেজীর পরীক্ষক আহমদিয়া মডেল হাই স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক মনিরুজ্জামান স্যারকে নিয়ে এসে স্কুলে নবম শ্রেণি চালু করার প্রস্তাব করলে সবাই সমর্থন করেন। সেই সভায় ছিদ্দিক মিয়া সাহেবের প্রস্তাব মেনে নিয়ে শিক্ষকতা শুরু করি। আর এক প্রতিবেশী নূর নবীকে রাজী করাই। আমরা দুইজন সদ্য কমার্স গ্র্যাজুয়েট বিধায় বাণিজ্য বিভাগ দিয়ে নবম শ্রেণি চালু হয় ওবায়েদ উল্যাহ মেমোরিয়াল হাই স্কুলে । ছিদ্দিক মিয়া নিজে আমাদের নিয়ে মনিরুজ্জামান স্যারকে রাজী করিয়েছিলেন । স্যার প্রধান শিক্ষক হিসাবে যোগ দিয়েছিলেন । আমি ছিলাম অবৈতনিক শিক্ষক ।

স্থান সংকুলানের অভাবে ছিদ্দিক মিয়া আমাদের কিশোর ক্লাবে শিক্ষকদের অফিস হিসাবে ব্যবহার করিয়েছিলেন । জামান স্যার যোগ দেয়ায় ও নবম শ্রেণি খোলার খবরের সাথে সাথে অভিবাবকেরা তাদের সন্তানদের স্কুলে ভর্তি করতে শুরু করেন ।
ডাকঘরটিকে তিনি সাব পোস্ট অফিসে উন্নীত করে যেতে পারেননি । যদিও অনেক চেষ্টা করেছেন । সবগুলি প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন কল্পে একবার জেলা প্রশাসক সাহেবকে দাওয়াত দিয়ে এনেছিলেন । তার সার্বিক তত্ত্বাবধানে বর্তমান ঈদগাহের জায়গায় ডিসি সাহেবকে সংবর্ধনা দেয়া হয় । জামান স্যার মানপত্র রচনা করে দিয়েছিলেন, আমি পাঠ করেছিলাম । ডিসি সাহেব বললেন, সাব পোস্ট অফিস করতে পোস্ট অফিসের নামে জমি লাগবে । লাতু মিয়াকে জমি দিতে রাজি করিয়েছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য, সে সময় জনাব ছিদ্দিক মিয়া সাহেব ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। সে জমিতে পরে ঈদগাহ প্রতিষ্ঠা ও মাদ্রাসা স্তানান্তরিত হয়।

এছাড়া নোয়াখালী মহিলা কলেজ প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন আমাদের এই ছিদ্দিক উল্লাহ মিয়া।
সাব-পোস্ট অফিসে উন্নীতকরণ প্রক্রিয়াধীন থাকা অবস্থায় এই একটি মাত্র কাজ অসম্পূর্ণ রেখে একদিন এই ক্ষণজন্মা একনিষ্ঠ সমাজ সেবক সর্বজন শ্রদ্ধেয় ছিদ্দিক উল্লাহ মিয়া ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে ১৯৯২ খৃষ্টাব্দের ২৯ জুন ইহকাল ত্যাগ করেন । তার উৎসাহ, উদ্দীপনায় এই মহৎ ব্যক্তির সাহচর্যে থেকে প্রতিষ্ঠানসমূহের সাথে জড়িত থাকতে পেরে নিজে গৌরব বোধ করছি । আমি মরহুম ছিদ্দিক উল্লাহ মিয়াকে পরম শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি, তার বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করি ।

Please Share This Post in Your Social Media

আপডেট: ০৩:৪৪:৩১ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৫ জুলাই ২০২৫
১১৫

একজন নিবেদিতপ্রাণ সমাজহিতৈষীকে স্মরণ

আপডেট: ০৩:৪৪:৩১ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৫ জুলাই ২০২৫

শহিদুল ইসলাম ফারুক : কালিতারা, জালিয়াল, সল্যাঘটিয়া, কিশোরগঞ্জ জেলার মরহুম ছিদ্দিক উল্লাহ মিয়া। পাক-কিশোরগঞ্জের সামান্য দক্ষিণে আজিজল হক মিয়ার বাড়ি সংলগ্ন রাজবাড়ি। ছিদ্দিক মিয়া ছিলেন মাইজদী মোহাম্মদী প্রেসের মালিক । কিন্তু পেশার প্রতি তার তেমন নজরদারীরি ছিল না। সারাক্ষণ তার চিন্তাভাবনা ছিল এলাকার উন্নয়ন । সকালে বাড়ি থেকে বের হয়ে কিশোরগঞ্জ এসে প্রথম কাজ মোস্তফা মিয়ার দোকানে আরো দুই পরম শ্রদ্ধেয় মরহুম আনোয়ার আহম্মদ আমীন সাহেব ও মরহুম রজ্জব আলী ভূঁইয়া সাহবের সাথে চা খাওয়া। তারপরেই চলতো উন্নয়নের আলাপ।

পাক কিশোরগঞ্জের প্রাইমারী স্কুল, চান মিয়া হাজীর মসজিদ ও মাদ্রাসা, ঈদগাহ, ওবায়েদ উল্লাহ মেমোরিয়াল হাই স্কুলসহ এই ছোট এলাকার সব প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠা ও উন্নয়নে ছিদ্দিক উল্লাহ মিয়ার ভূমিকা ছিল মুখ্য । তখন কালিতারার পরে পশ্চিমে বিদ্যুৎ ছিল না । তিনি চান মিয়া হাজীর মসজিদে বিদ্যুৎ আনার পারমিশন করিয়েছিলেন। কিন্তু সরকার থেকে কোন খুঁটি ও লেবার মজুরি দেয়নি । তিনি বন্ধু-বান্ধবদের, কিশোর ক্লাবের সদস্যদের ও এলাকার যুবকদের সাথে নিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরে গাছ সংগ্রহ করিয়েছিলেন। নিজেরা কেটে সবাই কাঁধে করে বহন করে গর্ত খুঁড়ে খঁটি গেড়ে প্রথম কালিতারার পরে পাক কিশোরগঞ্জের মসজিদে বিদ্যুৎ আনা হয়েছিল।

মুক্তিযুদ্ধ শুরুর ঠিক পূর্ব ক্ষণে এলাকার গৌরব মরহুম ওবায়েদ উল্লাহ সাহেবের যোগ্য সন্তান বাবু মিয়া সাহেবকে তার পিতার নামে উনার স্মৃতি বিজড়িত অঞ্চলে তার স্মৃতি রক্ষায় একটি স্কুল স্থাপনের জন্য উদ্বুদ্ধ করেছিলেন তিনি । তারপর আরো দুই শ্রদ্ধেয় মরহুম রাজ্জাক পাটোয়ারী স্যার ও মরহুম গোলাম মোস্তফা সাহেবের সার্বিক সহযোগিতায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ওবায়েদ উল্লাহ মেমোরিয়াল জুনিয়র হাই স্কুল । এক পর্যায়ে তিন ক্লাসে ছাত্র সংখ্যা দাঁড়ায় জনা বিশেকে । স্কুলগৃহ ঘুর্ণি ঝড়ে পড়ে যায় । স্কুলের চরম দুঃসময়ে ১৯৭৭ বা ১৯৭৮ সালের জানুয়ারীর এক তারিখে নতুন ছাত্র ভর্তি উপলক্ষে তখনকার প্রধান শিক্ষক হাকিম সাহেবকে দিয়ে এক অভিবাবক সভা ডাকেন স্কুলের মাঠে । মহিলা কলেজের প্রিন্সিপ্যাল মরহুম ছালেহ আহমদ স্যার সে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন । আর ছিলেন কালিতারা গার্লস স্কুলের প্রধান শিক্ষক মাহে আলম সাহেব ।
তার কথা মত সবার উপস্থিতিতে আমি আমার বক্তব্যে প্রধান শিক্ষক হাকিম সাহেবকে বাদ দিয়ে প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ কুমিল্লা বোর্ডের বাংলা ও ইংরেজীর পরীক্ষক আহমদিয়া মডেল হাই স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক মনিরুজ্জামান স্যারকে নিয়ে এসে স্কুলে নবম শ্রেণি চালু করার প্রস্তাব করলে সবাই সমর্থন করেন। সেই সভায় ছিদ্দিক মিয়া সাহেবের প্রস্তাব মেনে নিয়ে শিক্ষকতা শুরু করি। আর এক প্রতিবেশী নূর নবীকে রাজী করাই। আমরা দুইজন সদ্য কমার্স গ্র্যাজুয়েট বিধায় বাণিজ্য বিভাগ দিয়ে নবম শ্রেণি চালু হয় ওবায়েদ উল্যাহ মেমোরিয়াল হাই স্কুলে । ছিদ্দিক মিয়া নিজে আমাদের নিয়ে মনিরুজ্জামান স্যারকে রাজী করিয়েছিলেন । স্যার প্রধান শিক্ষক হিসাবে যোগ দিয়েছিলেন । আমি ছিলাম অবৈতনিক শিক্ষক ।

স্থান সংকুলানের অভাবে ছিদ্দিক মিয়া আমাদের কিশোর ক্লাবে শিক্ষকদের অফিস হিসাবে ব্যবহার করিয়েছিলেন । জামান স্যার যোগ দেয়ায় ও নবম শ্রেণি খোলার খবরের সাথে সাথে অভিবাবকেরা তাদের সন্তানদের স্কুলে ভর্তি করতে শুরু করেন ।
ডাকঘরটিকে তিনি সাব পোস্ট অফিসে উন্নীত করে যেতে পারেননি । যদিও অনেক চেষ্টা করেছেন । সবগুলি প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন কল্পে একবার জেলা প্রশাসক সাহেবকে দাওয়াত দিয়ে এনেছিলেন । তার সার্বিক তত্ত্বাবধানে বর্তমান ঈদগাহের জায়গায় ডিসি সাহেবকে সংবর্ধনা দেয়া হয় । জামান স্যার মানপত্র রচনা করে দিয়েছিলেন, আমি পাঠ করেছিলাম । ডিসি সাহেব বললেন, সাব পোস্ট অফিস করতে পোস্ট অফিসের নামে জমি লাগবে । লাতু মিয়াকে জমি দিতে রাজি করিয়েছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য, সে সময় জনাব ছিদ্দিক মিয়া সাহেব ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। সে জমিতে পরে ঈদগাহ প্রতিষ্ঠা ও মাদ্রাসা স্তানান্তরিত হয়।

এছাড়া নোয়াখালী মহিলা কলেজ প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন আমাদের এই ছিদ্দিক উল্লাহ মিয়া।
সাব-পোস্ট অফিসে উন্নীতকরণ প্রক্রিয়াধীন থাকা অবস্থায় এই একটি মাত্র কাজ অসম্পূর্ণ রেখে একদিন এই ক্ষণজন্মা একনিষ্ঠ সমাজ সেবক সর্বজন শ্রদ্ধেয় ছিদ্দিক উল্লাহ মিয়া ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে ১৯৯২ খৃষ্টাব্দের ২৯ জুন ইহকাল ত্যাগ করেন । তার উৎসাহ, উদ্দীপনায় এই মহৎ ব্যক্তির সাহচর্যে থেকে প্রতিষ্ঠানসমূহের সাথে জড়িত থাকতে পেরে নিজে গৌরব বোধ করছি । আমি মরহুম ছিদ্দিক উল্লাহ মিয়াকে পরম শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি, তার বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করি ।